কৃষকের জানালা বা ডিজিটাল সিস্টেম অফ প্লান্টস প্রবলেম আইডেনটিফিকেশন ( ডিপিপিআইএস ) কৃষকদের ফসলের নানা সমস্যার দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান দেওয়ার একটি ডিজিটাল প্রয়াস। ফসলভিত্তিক নানা সমস্যার চিত্র যৌক্তিকভাবে সাজিয়ে এটি তৈরী করা হয়েছে । এখানে ছবি দেখে কৃষক নিজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারেন এবং চিহ্নিত ছবিতে ক্লিক করলেই সমস্যার সমাধান মনিটরে ভেসে উঠবে। এখানে মাঠ ফসল, শাক-সব্জি, ফল-মূল ও অন্যান্য গাছের রোগ-বালাই, পোকা-মাকড়, সারের ঘাটতি বা অন্যান্য কারণে যেসব সমস্যা হয়; সেসব সমস্যা ও তার সমাধান যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি সমস্যার একাধিক ছবি এবং কমপক্ষে একটি প্রতিনিধিত্বপূর্ণ ছবি যুক্ত করা হয়েছে; যাতে কৃষক সহজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারে।
পটভূমি
জনাব মো: আব্দুল মালেক, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার (তৎকালীন), ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ এর একটি উদ্ভাবনী উদ্যোগ হল ডিজিটাল সিস্টেম অফ প্লান্ট’স প্রবলেম আইডেনটিফিকেশন (ডিপিপিআইএস)। কৃষি পরামর্শ সেবা নিতে এসে যেসব কৃষক তাদের ফসলের সমস্যাটি ভালভাবে বলতে পারেন না, তাদেরকে তাদের ফসলের সমস্যা বলতে সহযোগিতা করার জন্য মাঠে সচরাচর হয় এমন কিছু সমস্যার ছবি তুলে কম্পিউটারে রাখা হয়। এরপর কৃষক কোন সমস্যা নিয়ে আসলে যারা সমস্যার কোন নমুনা নিয়ে আসেন না, তাদের সে ছবিগুলো দেখানো হয়। দেখা গেল এটি খুব ভাল কাজ করছে। কৃষক ছবি দেখে নিজেই তার ফসলের সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারছেন। এরপর ছবিগুলোর সাথে সমস্যার সমাধান যুক্ত করা হল। এবার এটি ফসলের সমস্যার সমাধান দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী উভয়ের জন্যই সহায়ক হল । কৃষকদের মতামত নেবার জন্য একাধিক জরিপ পরিচালনা করা হয় । এতে দেখা যায় যেসব কৃষক তখনও এ পদ্ধতিতে সেবা নেননি তাদের মধ্যে ৭৬% এবং যারা এ পদ্ধতিতে সেবা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ১০০% কৃষক মনে করেন পদ্ধতিটি তাদের জন্য সহায়ক । পরবর্তীতে এই ধারনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম পরিচালিত “পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন বাংলাদেশ” নামক ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা হয়। এতে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। অসংখ্য মন্তব্য ও পরামর্শ আসে বিশিষ্ট্যজনদের কাছ থেকে। পরামর্শ আসে ডিপিপিআইএস এর একটি বাংলা নাম দিয়ে তা কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার। সে আলোকেই ডিপিপিআইএস এর নামকরণ করা হয় “কৃষকের জানালা”। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যেমন কৃষক তার ক্ষেত/ফসল দেখতে পায়, তেমনি এই কৃষকের জানালায় উঁকি দিয়েও কৃষক তার ক্ষেতের বা ফসলের সমস্যা ও তার সমাধান দেখতে পাবে। কৃষেকের জানালাকে পূর্ণাঙ্গরূপে তৈরি করতে এবং বিশেজ্ঞদের দ্বারা প্রমিতকরণের জন্য এটুআই প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডে ‘ডিজিটালি কমপ্লিশন এন্ড স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অফ প্লান্ট’স প্রবলেম আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম (ডিপিপিআইএস) নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। অনেক যাচাই বাছাই শেষে প্রকল্পটি পুরস্কৃত হয়।
কৃষকের জানালা তৈরি
প্রায় দুই বছর ধরে সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ফসলের নানা সমস্যার ছবি তোলা হয় এবং সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করার পর তা ডাটাবেজে যুক্ত করা হয়। প্রায় ৮০,০০০ ছবি থেকে বাছাই করে ১২০ টি ফসলের ১০০০ এর বেশি সমস্যার ছবি সমাধানসহ পর্যায়ক্রমে যুক্ত করে কৃষকের জানালা তৈরি করা হয় ।
কৃষকের জানালা প্রমিতকরণ
প্রতি ১০০ টি সমস্যা কৃষকের জানালায় যুক্ত হলে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট কমিটির মিটিং আহবান করে তা পর্যালোচনা করা হয় । এভাবে ১১ টি মিটিংএ ১০০০ এর বেশি সমস্যা ও তার সমাধান পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর তা চুড়ান্ত করা হয়।
উদ্যোগের যৌক্তিকতা
কৃষকের জানালা ব্যবহার করে সেবা গ্রহিতা ও সেবা প্রদানকারী উভয়েই উপকৃত হচ্ছেন। সেবা গ্রহিতা দ্রূত ও সঠিক সেবা পাচ্ছেন আর সেবা প্রদানকারী কৃষকের জানালা ব্যবহার করে যে কোন সমস্যার খুব সহজেই দ্রুত ও নির্ভুল সমাধান দিতে পারছেন। কৃষকের জানালা ব্যবহার করলে সেবা গ্রহিতা ও সেবা প্রদানকারীর মধ্যকার সম্ভাব্য কমুনিকেশন নয়েজ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। কৃষকের জানালা আসলে কৃষককে তার সমস্যাটি সম্প্রসারণ কর্মীর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সহায়তা করে। এটি ব্যবহার করে একজন অগ্রসর কৃষক নিজেও তার ফসলের সমস্যার সমাধান করতে পারেন।
উদ্ভাবনের ফলাফল
# সেবা পেতে / দিতে ৬৬.৬৬ % পর্যন্ত সময় সাশ্রয় হয়েছে
# সেবা পেতে / দিতে ৮৬.০০ % পর্যন্ত খরচ সাশ্রয় হয়েছে
# সেবা পেতে / দিতে ৬৬.৬৬ % পর্যন্ত যাতায়াত সাশ্রয় হয়েছে
# কৃষক বিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রমিত সঠিক পরামর্শ সেবা পাচ্ছেন
# কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা: ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, ফিয়াক ও এআইসিসির মাধ্যমে বাড়ীর কাছেই কৃষক সেবা পাচ্ছেন
# কৃষকের হাতের মুঠোয় সেবা: অনেক অগ্রসর কৃষক মোবাইলে কৃষকের জানালা ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক সেবা পাচ্ছেন
বৈশিষ্ট্য:
১. ব্যবহার করা সহজ ও ব্যবহারকারী বান্ধব।
২. এটি কৃষক বান্ধব: কৃষকের জানালায় ব্যবহৃত প্রতিটি ছবি মাঠ থেকে তোলা এবং কৃষক মাঠে সমস্যাটি ঠিক যেমন দেখতে পান ঠিক সেরকম ছবিই ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে কৃষক সঠিকভাবে সমস্যাটি চিনতে পারেন।( গবেষণায় দেখা গেছে- ঝকমকে ও ফটোশপে কাজ করা ছবি কৃষকদের বিভ্রান্ত করে। মাঠের অবস্থার সাথে মিল না পেলে কৃষক সমস্যাটি চিনতে পারেন না।
৩. এটি পরিবেশ বান্ধব: এতে বালাই ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং কৃষকের আচরণগত পরিবর্তন যোগাযোগ (এফবিসিসি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; যা কৃষকদের মধ্যে এমন কিছু আচরণগত পরিবর্তন আনবে যার ফলে পরবর্তী সময়ে একই সমস্যার পূনরাবৃত্তি কমে আসবে এবং রাসায়নিক বালাই নাশকের ব্যবহারও কমে আসবে। একইসাথে এতে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে যা এলোপাথারি রাসায়নিক বালাই নাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনবে।
৪. অংশগ্রহণমূলক: কৃষকের জানালায় ছবি দেখে কৃষক নিজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করছেন ফলে তিনি সমাধান পাওয়ার সাথে সাথে বিষয়টি নিজেও শিখছেন।
৫. ডিভাইস রেসপনসিভ: কৃষকের জানালা যেকোন কম্পিউটার, ল্যাপটব, ট্যাব ও স্মার্ট ফোন বা এন্ড্রোয়েড মোবাইলে ব্যবহার করা যায় ।
৬. প্রমিত কৃষি সম্প্রসারণ টুল: কৃষকের জানালাকে দেশের কৃষি গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি শিক্ষার সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট কমিটি কর্তৃক প্রমিত (standerdized) করা হয়েছে।
ঘোষনা : কৃষকের জানালা কৃষকদের ফসলের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান দেয়ার সহায়ক উপকরণ মাত্র । সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শই চুড়ান্ত ।